"কলনাৎ সর্ব ভূতানাং সঃ কালঃ পরিকীর্ত্তিতঃ
মহাকালস্য কলনাৎ সঃ কানী পরিকীর্তিতা।"
তাৎপর্যঃ- সর্বভূত অর্থাৎ জীবজগতকে যিনি কলন অর্থাৎ গ্রাস করেন, তিনি কাল বা মহাকাল। আর মহাকালকে যিনি গ্রাস করেন তিনিই হচ্ছেন কালী। আমরা কালি বলতে দক্ষিনা কালীকেই বুঝি। কালীঘাট থেকে আরম্ভ করে বাংলার সর্বত্রই দক্ষিণাকালী বিরাজমান। দক্ষিন শব্দের অর্থ পুরুষকে বোঝায়। বামা বোঝায় শক্তিকে। শক্তি যখন পুরুষকে দ্রবীভূত করে তখন শক্তির অনুবর্তী হয় পুরুষ। তখন শক্তি মহামোক্ষদায়িনীরূপে আমাদের নিকট প্রতিভাত হন। এ জন্য আমরা কালী বলতে দক্ষিণাকালীকেই বুঝে থাকি।
বৃহদারণ্যক উপনিষদে আমাদের অসৎ হতে সৎ -এ নিয়ে যাওয়ার জন্য, অন্ধকার থেকে আলোতে এবং মৃত্যু থেকে অমৃতত্বে যাওয়ার জন্য প্রার্থনা করা হয়েছে। পরলোকগত স্বজন ও বন্ধুগণ যাতে ঐ সব ভয়ঙ্কর অন্ধকার অতিক্রম করে গন্তব্য স্থল অমৃতধামে যেতে পারেন তার জন্য ঐ দিন রাতে নদীর জলে জলন্ত প্রদীপ ভাসানোর প্রথা বাংলার কোন কোন জায়গায় দৃষ্ট হয়। আবার আশ্বিনের সংক্রান্তি থেকে কার্তিক মাসব্যাপী আকাশ প্রদীপ জ্বালানোর মাধ্যমে অশুভ শক্তি তাড়ানোর ব্যবস্থা এতে নিহিত রয়েছে।
কালী বিলাসতন্ত্রে বলা হয়েছে -
"কার্ত্তিকে কৃষ্ণ পক্ষে তু পক্ষদশ্যাং মহানিশি।
আবির্ভূতা মহাকালী যোগিনী কোটিভিঃ সহ।।"
অর্থাৎ -- কার্ত্তিক মাসের অমাবস্যার মহানিশিতে মহাদেবীর এই ভূ-মন্ডলে আবির্ভাব তিথি। এদিন দীপাবলী বা দীপদান তথা দেওয়ালী রজনী। কার্ত্তিক অমাবস্যার রাতে দীপদানে আলোক মালায় প্রজ্জ্বলিত করে নিজেদের অন্ধকার থেকে আলোকে নিয়ে যাওয়ারই নামান্তর দীপাবলী। আলোর মাধ্যমে শক্তি সাধনায় নিজেকে পুণ্যালোকে আলোকময় করে তোলাই জগতের মূলে শক্তি সাধনার অন্তনির্হিত তাৎপর্য্যের সার্থকতা।রহস্যপূজা এবং সাধন রহস্যে বলা হয়েছে ----
"ন দিবা পূজায়দ্দেবীং রাত্রৌ নৈব চ নৈবচ।
সর্বদা পূজয়ে দেবীং দিবা রাত্রৌ বিবর্জয়েৎ।।"
অর্থাৎ -দেবীকে দিনে ও না, রাত্রিতে ও না সর্বদাই পূজা করবে।
কালীর দ্বিবিধরূপ - সংহাররূপ ও সৃষ্টিরূপ।
সংহাররূপ - কালী সংহারমূর্ত্তি। কিন্তু এই সংহার নিষ্ঠুর ধ্বংস নয়। এই সংহার সংহরণ অর্থাৎ আপনার মধ্যে আকর্ষণ। সমুদ্রের তরঙ্গমালার উদ্ভব সমুদ্র থেকেই। আবার সেই তরঙ্গমালার লয়ও হয় সমুদ্র বক্ষে। সংহার তেমনই একটি ব্যাপার। এটি হলো তার নাশিনী শক্তি।
সৃষ্টিরূপ - আদ্যাশক্তি বিশ্বপ্রসবকারিনী মায়ের উদর থেকেই জগৎ প্রপঞ্চের সৃষ্টি। তখন তিনি সৃজনী শক্তি।
জীবনের সাথে এই শক্তির খেলা আর্য্য প্রচীন সাধকগণ তাঁদের জ্ঞানদীপ্ত উপলব্ধিতে প্রত্যক্ষ করেছেন। এই সৃষ্টিতে প্রকৃতিরূপা মাতৃশক্তির রূপ কল্পনা কালী মূর্তিতে। শক্তির আধারভূতা দেবী শ্রী শ্রী কালীমাতা সকলের পরিত্রাণ করুন, সকলের জীবনে কালীমায়ের মূর্তির তাৎপর্য প্রাণবন্ত হোক, কর্মে সাত্ত্বিকতা আসুক- এই প্রার্থনা রাখি।
আধ্যাত্মিক বৈদিক, লৌকিক, আঞ্চলিক দেবদেবীর বাহনরূপে পশুপাখির অবস্থান নির্দিষ্ট হয়েছে। কিন্তু ব্যতিক্রম হলো দেবী কালিকার ক্ষেত্রে। এখানে দেবীর বাহনরূপে শিব ও শবকে বাহন নির্দিষ্ট হয়েছেন। দেবীকে শিবারূঢ়া বলতে শিবের উপর অবস্থিত বোঝায়, অপর পক্ষে শিবা শব্দে শৃগালও বোঝায়। এ কারণে অনেক স্থলে মায়ের মূর্তির সাথে শৃগালকেও দেখানো হয়। কিন্তু মায়ের সাথে শৃগালের যুক্ততা যুক্তিগ্রাহ্য নয়। শবারূঢ়া বা শিবারূঢ়া যা-ই বলি শব হয় শক্তিহীনতায় আর শিব হয় মঙ্গলকারী শক্তিমানতায়। উভয়ই শক্তির অবস্থান নির্ণয় করে। যে শক্তি সর্বত্র বিরাজিত নানরূপে কার্যকারিতায় তাঁর বাহন নির্ধারণ না করাই যুক্তিগ্রাহ্য বলে সাধকগণ এ বিষয়ে দৃষ্টি দেননি। ঋষি অরবিন্দ বিশ্বাস করতেন শাস্ত্রে মায়ের যে সকল মূর্তি আছে তাঁর মধ্যে মূলে রয়েছে কালীমাতা। শ্রী অরবিন্দেরও কালী দর্শন হয়েছিল যা অনেকেরই অজানা। মা সৃষ্টি ও রক্ষা দু’টোই করেন। ধ্বংস অনিবার্যভাবে সৃষ্টির ক্রম অনুযায়ী আসে। মানুষ বিপদে পড়লে মাকে ডাকে। ছোট শিশু মায়ের স্পর্শেই শক্তি পায়। পরিশ্রান্ত, ক্লান্ত মানুষ ঘুমের মাধ্যমে মায়ের কোলে আশ্রয় নিয়ে পুনঃশক্তি সঞ্চার করে কর্মে প্রবৃত্ত হয়। মায়ের কোলেই সন্তানের যে কোন সময় একমাত্র নিরাপদ আশ্রয়। মায়ের সস্নেহেই মানুষের বৃদ্ধি ঘটে।
কালীবীজ জপলে ও তদনুযায়ী গুরুপাদিষ্ট মতে ক্রিয়া করলে তত্ত্বময়ী কালী সাধকের সঙ্গী হয়ে যান। কৃষ্ণানন্দ, রামপ্রসাদ, রামকৃষ্ণ, বামাক্ষেপা প্রমুখ সাধক কালী দর্শনে মুগ্ধ তন্ময়। ‘‘প্রত্যয় হয় প্রত্যক্ষ হলে।’’ সমস্ত যোগতত্ত্ব কথা গুরুবক্তগম্য। সকল তত্ত্ব নিজের কাছে বিশ্বাসযোগ্য মনে হবে যদি গুরুপাদিষ্ট মতে সাধন ভজন করা যায়। মানুষকে সাধনমুখী, সত্যমুখী করার জন্যই পূজার ও দেব-দেবীর মূর্তির অবতারণা।
কালীপূজা আমাদেরকে কালীতত্ত্বভিমুখী করুক-এই প্রার্থনা মায়ের শ্রী চরণে। কালী ভাবনায় জীবনের সকল কালো দূর হয়ে যাক আসুক মহাকালের গতি।
মা সর্বব্যাপী। তাই মাকে সর্বদা স্মরণে রেখে প্রণাম জানাই ----
'যা দেবী সর্বভূতেষু মাতৃরূপেন সংস্থিতা
নমস্তস্যৈ নমস্তস্যৈ নমস্তস্যৈ নমো নমঃ।'----- শ্রী শ্রী চন্ডী
No comments:
Post a Comment