কালী তত্ত্বের উৎস
✍ বেদের রাত্রি সূক্তই পরবর্তীকালে কালীর ধারার সৃষ্টি করেছে। শতপথ ব্রাহ্মনে ও ঐতরেয় ব্রাহ্মনে নির্ঋত দেবীর উল্লেখ পাওয়া যায়।
বৈদিক সাহিত্যে কালীর নাম প্রথম পাই মুন্ডক উপনিষদে। সেখানে কালী যজ্ঞাগ্নির সপ্তজিহবার একটি। এখানে কালী আহুতি গ্রহণকারিনী অগ্নিজিহবা মাত্র। মহাভারতের সৌপ্তিক পর্বে দেখা যায় অশ্বত্থামা যখন পান্ডব শিবিরে গিয়ে নিদ্রিত বীরগণকে হত্যা করছিলেন তখন হন্যমান বীরগণ ভয়ংকরী কালীমূর্তি দেখতে পেয়েছিলেন। কালি দাসের ‘‘কুমার মম্ভব’’ -এ মহাদেবের বিবাহ প্রসঙ্গে
বরযাত্রার বর্ণনায় মার্তৃগনের সাথে মহাদেবের বিবাহযাত্রায় কালী অনুগমন করেছিলেন। মার্কন্ডেয় চন্ডীতে চন্ডমুন্ড এবং তাঁদের অনুচরেরা দেবীর নিকটবর্তী হলে দেবী অত্যন্ত কোপ প্রকাশ করলেন। তাঁর ভ্রুকুটি কুটিল ললাট থেকে অসি পাশ ধারিণী করাল বদনাকালী আবির্ভূত হন।
☞ কালী বিলাসতন্ত্রে বলা হয়েছে –
"কার্ত্তিকে কৃষ্ণ পক্ষে তু পক্ষদশ্যাং মহানিশি।
আবির্ভূতা মহাকালী যোগিনী কোটি ভিঃ সহা।।"
অর্থাৎঃ কার্ত্তিক মাসের অমাবস্যার মহানিশিতে মহাদেবীর এই ভূ-মন্ডলে আবির্ভাব। এটাই তার আবির্ভাব তিথি। এদিন দীপাবলী বা দীপদান তথা দেওয়ালী রজনী। কার্ত্তিক অমাবস্যার রাতে দীপদানে আলোক মালায় প্রজ্জ্বলিত করে নিজেদের অন্ধকার থেকে আলোকে নিয়ে যাওয়ারই নামান্তর দীপাবলী। আলোর মাধ্যমে শক্তি সাধনায় নিজেকে পুণ্যালোকে আলোকময় করে তোলাই জগতের মূলে শক্তি সাধনার অন্তনির্হিত তাৎপর্য্যের সার্থকতা।
☞ বৃহদারণ্যক উপনিষদে আমাদের অসৎ হতে সৎ -এ নিয়ে যাওয়ার জন্য, অন্ধকার থেকে আলোতে এবং মৃত্যু থেকে অমৃতত্বে যাওয়ার জন্য প্রার্থনা করা হয়েছে। পরলোকগত স্বজন ও বন্ধুগণ যাতে ঐ সব ভয়ঙ্কর অন্ধকার অতিক্রম করে গন্তব্য স্থল অমৃতধামে যেতে পারেন।
মা কালীর মূর্তির বিভিন্ন অঙ্গের অর্থ বর্ণনঃ-
শিবের ওপর কালীঃ- মহাদেব এখানে শব রূপ । এর মৃত্যুরুপ শিবের বুকে স্বয়ং জগত মাতা। এর মানে হল মৃত্যু কে জয় ।
দিগম্বরীঃ- দেবী কালী দিগম্বরী । এর অর্থ তিনি কোন কিছুর বন্ধনে আবদ্ধ নন । তিনি দেশ কালের ওপরে । তিনি সকল জীবের মাতা ।
এ প্রসঙ্গে বলা প্রয়োজন কিছু পণ্ডিত বসনকে কামনা বাসনার প্রতীক বলেছেন । ভগবান শ্রী কৃষ্ণ গোপীনি দের বস্ত্র হরণ করেছিলেন । যারা মূর্খ , নাস্তিক তারা এর মধ্যে অশ্লীলতার প্রসঙ্গ খোঁজেন ।
এর মানে কিন্তু এই না আমাদের বসনহীন হয়ে থাকতে হবে । খালি কামনা বাসনা আদি ষড়রিপু বর্জন করতে হবে । তবেই দেবকৃপা পাওয়া যাবে । তাই সম্পূর্ণ রিক্ত হয়ে অহং ও অবিদ্যা কে ত্যাগ করেই মায়ের কাছে যেতে হবে ।
মুক্তকেশীঃ- মা মুক্ত স্বভাবা । তাই তিনি মুক্তকেশী । তাঁর জ্ঞান খড়গের দ্বারা অষ্টপাশ ছিন্ন হলেই নিস্কাম সাধক দেবীর কৃপা পান । তবেই মুক্তি ঘটে। রামপ্রসাদ তাই গাইলেনঃ--
“ মুক্ত কর মা মুক্তকেশী
ভবে যন্ত্রনা পাই দিবানিশি । ”
ভবে যন্ত্রনা পাই দিবানিশি । ”
দেবী কালীর সেই কেশ মৃত্যুর প্রতীক । চন্ডীতে আছে মহিষাসুরের হাতে পরাজিত দেবতারা যখন ত্রিদেবের কাছে গেলেন তখন ত্রিদেব ও সমস্ত দেবতাদের তেজ রাশি একত্রিত হয়ে ভগবতী মহামায়ার আবির্ভাব ঘটে । যমের তেজে দেবীর কেশরাশি গঠিত হয় ।
মুন্ডমালাঃ- মায়ের কন্ঠে মুণ্ডমালা । কন্ঠমালা পঞ্চাশৎ । যা সংস্কৃত পঞ্চাশৎ বর্ণমালার প্রতীক । শব্দই হল ব্রহ্ম। কামধেনু তন্ত্রে দেবী স্বয়ং বলেছেনঃ---
“ মম কণ্ঠে স্থিতং বীজং পঞ্চাশদ্ বর্ণমদ্ভুতম্ । ”
“ মম কণ্ঠে স্থিতং বীজং পঞ্চাশদ্ বর্ণমদ্ভুতম্ । ”
রামপ্রসাদ তাই গেয়েছেনঃ--
"যত শোন কর্ণপুটে সকল মায়ের মন্ত্র বটে ।
কালী পঞ্চাশৎ বর্ণময়ী বর্ণে বর্ণে নাম ধরে ।"
মুন্ডমালা হল জ্ঞান শক্তির প্রতীক। দেবী ব্রহ্মজ্ঞান প্রদান করেন। তিনি চেতনা দান করেন। অন্ধকারে আবদ্ধ জীবকে আলোর পথ দেখান।
কালী পঞ্চাশৎ বর্ণময়ী বর্ণে বর্ণে নাম ধরে ।"
মুন্ডমালা হল জ্ঞান শক্তির প্রতীক। দেবী ব্রহ্মজ্ঞান প্রদান করেন। তিনি চেতনা দান করেন। অন্ধকারে আবদ্ধ জীবকে আলোর পথ দেখান।
হস্তের মেখলাঃ- দেবী কালী কটি দেশে নর হস্তের মেখলা । কিন্তু কেন ? হস্ত কর্মশক্তির প্রতীক ।
ত্রিনয়নীঃ- দেবী কালীর ত্রিনয়ন । দেবীর একটি নয়ন চন্দ্র স্বরূপ , আর একটি সূর্য স্বরূপ । তৃতীয়টি অগ্নি স্বরূপ । দেবী ভূত , ভবিষ্যৎ , বর্তমান সব কিছুই প্রত্যক্ষ করেন । তাঁর ত্রিনয়নের ইঙ্গিতেই ত্রিকাল নিয়ন্ত্রিত হয়।
প্রকাশ্য দিবালোকে , সন্ধ্যায় বা রাত্রে আমরা যে কাজ করিনা কেন তিনি দেখছেন। আমরা যদি গোপনে পাপ কাজ করে প্রভাব খাটিয়ে এই পৃথিবীর বিচারসভার হাত থেকে নিস্কৃতি পাইও , তবুও দেবী সব দেখেন – তাঁর বিচার থেকে নিস্কৃতি পাওয়া যাবে না ।
চারহস্তঃ- দেবীর চার হাত । তাঁর ওপরের দুহাতে অভয় ও খড়গ । নীচে বর মুদ্রা ও ছিন্ন নরমুণ্ড । অভয় ও বরামুদ্রা সৃষ্টির প্রতীক ।
খড়গ ও ছিন্ন নরমুণ্ড ধ্বংসের প্রতীক । দুটি বিপরীত কাজ হলেও আমরা মা কালীর মধ্যে দুটিকেই দেখতে পাই । এর অর্থ দেবী কালীর ইচ্ছাতেই সৃষ্টি হয় , তার ইচ্ছাতেই ধ্বংস হয় । দেবী তার খড়গ দ্বারা অবিদ্যা রুপী অসুরকে ধ্বংস করেন ।
কৃষ্ণবর্ণঃ- কালী মাতা কৃষ্ণবর্ণা । আদিতে যখন বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ড কিছুই ছিল না তখনও তিনি ছিলেন । তিনি অনন্ত । তিনি আদিতেও ছিলেন , তাই তিনি কৃষ্ণবর্ণা । কখনো তিনি নীলবর্ণা ।
যা সুদীর্ঘ সুনীল নীল আকাশের তুলনীয় । এর অর্থ দেবী অনন্ত । অনন্ত তার লীলা প্রকাশ । যা ব্রহ্মা , বিষ্ণু , মহেশ্বরের অগোচর ।
বিবসনা স্তন্য, দেবী কালী উলঙ্গিনীঃ- তাই কিছু নাস্তিক , মূর্খ ও বুদ্ধিজীবি শ্রেনীর মানুষ অনেক সময় খারাপ কিছুর সঙ্গে উলঙ্গিনী মায়ের তুলনা করে বসেন ।
মা উলঙ্গিনী বটে – কিন্তু তিনি যে তাঁর বাৎসল্যের স্নেহধারা তাঁর সকল সন্তান দের জন্যই রেখেছেন। তিনিই ত অন্নপূর্ণা রুপে ধান , শস্যে ভরিয়ে দিয়েছেন ।
তিনি শাকম্ভরী , তিনিই শতাক্ষী । মা হল পরম করুণাময়ী। সন্তানের দুঃখে তিনি কাঁদেন , সন্তানের উল্লাসেই তিনি আনন্দিত হন।
এখানে একটা কথা বলা প্রয়োজন । অনেক পণ্ডিতরা বলেন মা শীতলা নাকি সকলকে বসন্ত রোগের জীবানু দেন ।
এমন কোন মা আছে যে তার সন্তান দের তিনি রোগ দেবেন ? তাঁর সন্তান রা রোগে কষ্ট পাবে আর তিনি দেখবেন । এমন ধারনা ‘মা’ শব্দের অপমান ।
রক্তমাখা জিহ্বাঃ- দেবীর রক্তমাখা জিহ্বা রজঃ গুনের প্রতীক । তিনি তার শ্বেত দন্ত পাটি দ্বারা জিহ্বা কেটেছেন । শ্বেত বর্ণ হল স্বত্বঃ গুনের প্রতীক । এর মানে মা আমাদের স্বত্বঃ গুন দ্বারা রজঃ গুনকে সংহত করার শিক্ষে দিচ্ছেন ।
মহা শ্মশ্মান বাসিনীঃ- বদেবী মহাশ্মশ্মান এ বিচরণ করেন । কর্মফল ভোগান্তে জীবের শেষ আশ্রয় স্থল হল শ্মশ্মান । যেখানে তারা জননীর কোলে সুখে নিদ্রা যায় ।
মায়ের আঁচল এর তুলনা কোটী কোটি স্বর্গের সাথেও হয় না । যেখানে বাৎসল্যের ছোঁয়া লেগেই থাকে । “ মায়ের কোলে ঘুমায় ছেলে , এ শান্তি মা কোথায় বল ?” মহানির্বাণ তন্ত্র বলেনঃ--
“ সৃষ্টৈরাদৌ ত্বমেকাসীত্তোমারুপগোচরম্ ”
ধ্বংসের দেবীঃ- ধ্বংসের মধ্যেই সৃষ্টির বীজ লুকিয়ে আছে । যেমন ঘন কালো রাত্রির পর দিন আসে । তেমনি ধ্বংসের পর সৃষ্টি হয় । ঘন কালো মেঘ বিদায় হলেই আকাশে ঝলমলে সূর্য ওঠে । তাই ধ্বংস ছাড়া সৃষ্টির বিকাশ সম্ভব নয় ।
মা কালী হলেন আদ্যাশক্তি । জগতের মূল শক্তি ইনি । ইনি মহা সরস্বতী । ইনিই মহা লক্ষ্মী । ইনি রুদ্রানী শিবানী । ইনি ব্রহ্মার শক্তি ব্রহ্মাণী , নারায়নের শক্তি নারায়নী , শিবের শক্তি শিবা । ইনি নারসিংহী , ইনি বারাহী , ইনি কৌমারী , গন্ধেশ্বরী ।
ইনি শ্রী রামচন্দ্রের শক্তি সীতা দেবী ( বামস্য জানকী ত্বং হি রাবনধ্বংসকারিনী ) , ইনি শ্রীকৃষ্ণের হ্লাদিনী শক্তি , ইনি শ্রী রামকৃষ্ণের সহধর্মিণী মা সারদা । ইনি মহিষমর্দিনী চণ্ডী , ইনি চামুন্ডা , কৌষিকী , দুর্গা ভগবতী । এই ব্রহ্মাণ্ড তাঁর ইচ্ছাতেই চলছে । মায়ের ইচ্ছা ভিন্ন গাছের একটা পাতাও নড়ে না ।
সংহার রুপিনীঃ- সংহার শব্দের অর্থ ঠিক ধবংস নয় । সংহরন । নিজের ভিতরে প্রত্যাকর্ষণ । যেমন সমুদ্রের ঊর্মিমালা সমুদ্রের বক্ষ থেকেই উদ্ভুত হয় আবার সমুদ্রেই লয় হয় । যেম্ন উর্ণণাভ নিজের গর্ভ থেকে জাল রচনা করে আবার নিজের পেটেই গুটিয়ে নেয় ।
মৃত্যুর অর্থ পৃথিবী থেকে , নিকট জনের থেকে চির বিদায় নেওয়া – কিন্তু সেই জগত জননীর কোলে আশ্রয় পাওয়া । এই ব্রহ্মাণ্ড সেই মহামায়ার ইচ্ছাতেই রচিত , সংহার কালে তিনি আবার সব গুটিয়ে নেন ।
দ্বীপাবলির তাৎপর্য কি?
কবি গুরু রবিন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন -----
‘‘কে যেন ডাক পাঠালো দীপালিকায় জ্বালাও আলো ঘরে ঘরে।
জ্বালাও আলো আপন প্রাণে আলোয় সাঁজাও আলোয় ধরিত্রীরে”।
সনাতন ধর্মালম্বীদের একটি বিশেষ মহিম্বান্বিত রজনী। পূর্ব দিকে উদিত সূর্য পশ্চিম দিকে অস্তমিত হওয়ার পর শুরু হবে দ্বীপ জ্বালানো। অঞ্চল ভেদে উৎসবকে দেওয়ালি, দীপান্বিতা, দীপালিকা, সুখরাত্রি, সুখসুপ্তিকা এবং যক্ষরাত্রি নামেও অভিহিত হয়। আজ সন্ধ্যার আগে মাটির প্রদীপ সাজানো হবে। অথবা কলা গাছের সতেজ খোল দিয়ে তৈরি করা হবে প্রদীপ।
তেলে জড়িয়ে সলতে প্রদীপে রাখা হবে। মোমবাতিও আনা হবে। কলার খোল দিয়ে বড় বড় করে কয়েকটি ডুঙ্গা তৈরি করে মৃত পূর্বপুরুষদের উদ্দেশ্যে শ্রদ্ধা জানানো হবে। তাতে ধূপ জ্বলবে কাঁসরের শব্দে আলতো হাতের স্রোতে ভাসবে প্রদীপ, সেই প্রজ্বলিত প্রদীপে এক অন্যরকম পরিবেশের সৃষ্টি হবে। পিতৃদেব-মাতৃদেবী কিংবা পূর্ব পুরুষদের উদ্দেশ্যে উদ্যত জোড় হস্তে শ্রদ্ধা জানানো হবে।
প্রত্যেক সার্বজনীন আনন্দের উৎসব মন্দের বিরুদ্ধে ভালোর জয়কে উদযাপন করা হয়। আলোকসজ্জার এই দ্বীপাবলিতে অন্ধকারের বিরুদ্ধে আলো জ্বালানোর দিন। নিজের ভেতরের বাহিরের সকল অজ্ঞতা ও তমঃকে দীপ শিখায় বিদূরিত করার দিন। প্রেম-প্রীতি-ভালবাসার চিরন্তন শিখা প্রজ্বলিত করার দিন। দেশ থেকে দেশে, অঞ্চল থেকে অঞ্চলে- এই দিনের মাহাত্ম্য ভিন্ন ভিন্ন; তবু মূল কথা এক। আর আধ্যাত্মিকতার গভীর দর্শনে এই দিন- আত্মাকে প্রজ্জ্বলিত করে পরিশুদ্ধ করে সেই পরমব্রহ্মে লীন হওয়ার দিন। রামায়ন অনুসারে আজকের দিনে ত্রেতা যুগে শ্রী রামরাবণ বধ করে চৌদ্দ বছরের বনবাস শেষে অযোধ্যায় প্রত্যাবর্তন করেন। শ্রী রামের চৌদ্দ বছর পরের প্রত্যাবর্তনে সারা রাজ্য জুড়ে প্রদীপ জ্বালানো হয়। প্রজারা খুশীতে শব্দবাজি করে। অনেকে মনে করেন দীপাবলীর আলোকসজ্জা এবং শব্দবাজি ত্রেতাযুগে রাম-রাজ্যে ঘটে যাওয়া সেই অধ্যায়কে সামনে রেখেই অন্যসব অঞ্চলে প্রচলিত হয়েছে, পরিচিত হয়েছে, বিস্তৃত হয়েছে।
দীপাবলী মূলত পাঁচদিন ব্যাপী উৎসব। দীপাবলীর আগের দিনের চতুর্দশীকে (এই দিনকে দীপাবলি উৎসবের প্রথম দিন বলা হয়) বলা হয় ‘নরক চতুর্দশী’, এই দিনে শ্রীকৃষ্ণ এবং তাঁর স্ত্রী সত্যভামা নরকাসুরকে বধ করেছিলেন। চতুর্দশী পরের অমাবস্যা তিথি দীপাবলি উৎসবের দ্বিতীয় দিন, কিন্তু এই দিনই মূল হিসেবে উদযাপিত হয়। এই দিন রাতে শাক্তরা শক্তি দেবী কালীর পূজা করেন। তাছাড়া এই দিনে লক্ষীপূজাও করা হয়, কথিত আছে এই দিনে ধন-সম্পদের দেবী লক্ষ্মী বরধাত্রী রূপে ভক্তের মনোকামনা পূর্ণ করেন। বিষ্ণুপুরান মতে, বিষ্ণুর বামন অবতার অসুর বলিকে পাতালে পাঠান; এই দিনে পৃথিবীতে এসে অন্ধকার ও অজ্ঞতা বিদূরিত করতে, ভালবাসা ও জ্ঞানের শিখা প্রজ্বলিত করতে অসুর বলিকে পৃথিবীতে এসে অযুদ অযুত প্রদীপ জ্বালানোর অনুমতি দেওয়া হয়।
দীপাবলীর তৃতীয় দিন - কার্তিকা শুদ্ধ, এই দিন অসুর বলি নরক থেকে বেরিয়ে পরিশুদ্ধ হয়ে বিষ্ণুর বরে পৃথিবী শাসন করে।চতুর্থ দিন হচ্ছে ভ্রাতৃ দ্বিতীয়া; একে যম দ্বিতীয়াও বলা হয়; এই দিন বোনেরা ভাইকে নিমন্ত্রণ করে, কপালে ফোঁটা দেয়, হাতে রাখী বেঁধে দেয়। রামায়ন মতে বিজয়া দশমীতে রাবন বধ এবং দ্বীপাবলির দিনে শ্রী রামচন্দ্রের অযোধ্যায় আগমন। তাই অনেকেই মনে করেন দীপাবলির মধ্য দিয়ে সমাপ্ত হয় শারদীয় দূর্গোৎসব। আসলে এ ধারনা সঠিক নয়। শাস্ত্র মতে-শুভ মহালয়ার মধ্য দিয়ে শুরু হয় দেবীপক্ষ। মহালয়ায় পিতৃপক্ষ সাঙ্গ করে দেবীপক্ষের দিকে যাত্রা শুরু হয। দুর্গাপূজা মূলত পাঁচদিনের অনুষ্ঠান হলেও মহালয়া থেকেই প্রকৃত উৎসবের সূচনা ও কোজাগরী লক্ষ্মীপূজায় তার সমাপ্তি। সৌর আশ্বিনের কৃষ্ণপক্ষের নাম মহালয়া। পুরাণে আছে, সৌর উত্তরায়ণকালে বিষ্ণুলোকে যখন দিন, যমলোকে তখন রাত-দক্ষিণায়ন। উত্তরায়ণের ছয় মাস দেবতারা জেগে থাকেন, বিষ্ণুলোকের তোরণ থাকে অবারিত। দক্ষিণায়নের ছয় মাস দেবতারা নিদ্রিত। কিন্তু যমলোকে দিনমান, দুয়ার খোলা। আজ দক্ষিণায়নের প্রথম দিনে ঘুম ভেঙে বদ্ধ দুয়ার ঠেলে পিতৃপুরুষরা ছুটে আসেন মর্ত্যলোকে। এ সময় তারা থাকেন ক্ষুধা-তৃষ্ণায় কাতর। উত্তরপুরুষদের হাতে একটু শ্রাদ্ধাহার পেলেই তারা পরম তৃপ্ত হন। সেই অনুসারে এই মহালয়া তিথিতে যারা পিতৃ-মাতৃহীন তারা তাদের পূর্বপূরূষের স্মরন করে, পূর্বপূরুষের আত্মার শান্তি কামনা করে অঞ্জলি প্রদান করেন।
মহালয়াতে অনেকে গঙ্গায় অঞ্জলি প্রদান করেন পূর্বদের আত্মার শান্তির জন্য, তাহারা শুধু পূর্বদের নয়, পৃথিবীর সমগ্র কিছুর জন্য প্রার্থনা ও অঞ্জলি প্রদান করেন। যে-অবান্ধবা বান্ধবা বা যেন্যজন্মনি বান্ধবা - অর্থাৎ যারা বন্ধু নন, অথবা আমার বন্ধু ও যারা জন্ম জন্মান্তরের আমার আত্মীয়-বন্ধু ছিলেন, তারা সকলেই আজ আমার অঞ্জলি গ্রহন করুন। যাদের পুত্র নেই, যাদের কেউ নেই আজ স্মরন করার তাদের জন্য ও অঞ্জলী প্রদান করতে হয়। যেযাং, ন মাতা, ন পিতা, ন বন্ধু - অর্থাৎ যাদের মাতা-পিতা-বন্ধু কেউ নেই আজ স্মরন করার তাদেরকে ও স্মরন করছি ও প্রার্থনা করছি তাদের আত্মারা তৃপ্তিলাভ করুক।
কালীর আবির্ভাব তিথি ও দীপাবলী -----কালী বিলাসতন্ত্রে বলা হয়েছে -----
কার্ত্তিকে কৃষ্ণ পক্ষে তু পক্ষদশ্যাং মহানিশি।
আবির্ভূতা মহাকালী যোগিনী কোটি ভিঃ সহা।।
অর্থাৎঃ কার্ত্তিক মাসের অমাবস্যার মহানিশিতে মহাদেবীর এই ভূ-মন্ডলে আবির্ভাব। এটাই তার আবির্ভাব তিথি। এদিন দীপাবলী বা দীপদান তথা দেওয়ালী রজনী। কার্ত্তিক অমাবস্যার রাতে দীপদানে আলোক মালায় প্রজ্জ্বলিত করে নিজেদের অন্ধকার থেকে আলোকে নিয়ে যাওয়ারই নামান্তর দীপাবলী। আলোর মাধ্যমে শক্তি সাধনায় নিজেকে পুণ্যালোকে আলোকময় করে তোলাই জগতের মূলে শক্তি সাধনার অন্তনির্হিত তাৎপর্যের সার্থকতা।দ্বীপাবলি সবার জীবনে সুখ নিয়ে আসুক। ঘুচে যাক সকল অন্ধকার, মুছে যাক সকল যন্ত্রনা। জ্বলুক শান্তির প্রদীপ;ভালবাসার প্রদীপ জ্বলুক।দেবী মা কালী
দেবী মা কালী
কালী বা কালিকা হলেন একজন হিন্দু দেবী। তাঁর অন্য নাম শ্যামা বা আদ্যাশক্তি। প্রধানত শাক্ত সম্প্রদায় কালীপূজা করে থাকে। তন্ত্র অনুসারে, কালী দশমহাবিদ্যা নামে পরিচিত দশজন প্রধান তান্ত্রিক দেবীর প্রথম। শাক্ত মতে, কালী বিশ্বব্রহ্মাণ্ড সৃষ্টির আদি কারণ। বাঙালি হিন্দু সমাজে কালীর মাতৃরূপের পূজা বিশেষ জনপ্রিয়।
পুরাণ ও তন্ত্র সাহিত্যে কালীর বিভিন্ন রূপের বর্ণনা পাওয়া যায়। এগুলি হল: দক্ষিণাকালী, ভদ্রকালী, সিদ্ধকালী, গুহ্যকালী, শ্মশানকালী, মহাকালী, রক্ষাকালী ইত্যাদি। আবার বিভিন্ন মন্দিরে "ব্রহ্মময়ী", "ভবতারিণী", "আনন্দময়ী", "করুণাময়ী" ইত্যাদি নামে কালীপ্রতিমা পূজা করা হয়। এই সব রূপের মধ্যে দক্ষিণাকালীর বিগ্রহই সর্বাধিক পরিচিত ও পূজিত। দক্ষিণাকালী চতুর্ভূজা। তাঁর চার হাতে খড়্গ, অসুরের ছিন্ন মুণ্ড, বর ও অভয়মুদ্রা রয়েছে। তাঁর গলায় রয়েছে নরমুণ্ডের মালা। দেবীর গায়ের রং কালো। মাথায় আলুলায়িত চুল এবং তিনি শিবের বুকে ডান পা আগে রেখে দণ্ডায়মান।
ব্রহ্মযামল নামক তন্ত্রগ্রন্থের মতে, কালী বঙ্গদেশের অধিষ্ঠাত্রী দেবী। আশ্বিন মাসের অমাবস্যা তিথিতে দীপান্বিতা কালীপূজা বিশেষ জাঁকজমক সহকারে পালিত হয়। এছাড়া মাঘ মাসের চতুর্দশী তিথিতে রটন্তী কালীপূজা ও জ্যৈষ্ঠ মাসে ফলহারিণী কালীপূজাও বিশেষ জনপ্রিয়। অনেক জায়গায় প্রতি অমাবস্যা এবং প্রতি মঙ্গলবার ও শনিবারে কালীপূজা হয়ে থাকে।
কালী দেবীর উপাসকরা হিন্দু বাঙালি সমাজে বিশেষ সম্মান পেয়ে থাকেন। এঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন রামকৃষ্ণ পরমহংস ও তাঁর শিষ্য স্বামী বিবেকানন্দ, রামপ্রসাদ সেন, কমলাকান্ত ভট্টাচার্য প্রমুখ। কালীকে বিষয়বস্তু করে রচিত ‘শ্যামাসংগীত’ বাংলা সাহিত্য ও সংগীত ধারার একটি গুরুত্বপূর্ণ বর্গ। রামপ্রসাদ সেন, কমলাকান্ত ভট্টাচার্য প্রমুখ কালী সাধকেরা এবং কাজী নজরুল ইসলাম, দ্বিজেন্দ্রলাল রায় প্রমুখ বিশিষ্ট কবিরা অনেক উৎকৃষ্ট শ্যামাসংগীত লিখেছেন। স্বামী বিবেকানন্দ ‘মৃত্যুরূপা কালী’ নামে একটি দীর্ঘকবিতা এবং তাঁর শিষ্যা ভগিনী নিবেদিতা মাতৃরূপা কালী নামে একটি প্রবন্ধ গ্রন্থ রচনা করেছিলেন।
পশ্চিমবঙ্গের রাজধানী কলকাতায় অনেক কালীমন্দির আছে। তাই ভারতের অন্যান্য অঞ্চলে কালীকে "কলকাত্তাওয়ালি" (কলকাতানিবাসিনী) বলা হয়। কলকাতার সবচেয়ে বিখ্যাত কালীমন্দিরটি হল কালীঘাট মন্দির। এটি একটি সতীপীঠ। এছাড়া দক্ষিণেশ্বর কালীবাড়ি, আদ্যাপীঠ, ঠনঠনিয়া কালীবাড়ি, ফিরিঙ্গি কালীবাড়ি ইত্যাদি কলকাতা অঞ্চলের বিখ্যাত কয়েকটি কালী মন্দির। এছাড়া লালনার সিদ্ধেশ্বরী কালীবাড়ি, দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার ময়দা কালীবাড়ি, উত্তর চব্বিশ পরগনার হালিশহরের রামপ্রসাদী কালী মন্দির ইত্যাদি পশ্চিমবঙ্গের বিখ্যাত কয়েকটি কালীমন্দির। বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা শহরের অধুনা ধ্বংসপ্রাপ্ত রমনা কালীমন্দির ছিল খুবই প্রাচীন একটি কালীমন্দির। ভারতের রাজধানী নতুন দিল্লির নতুন দিল্লি কালীবাড়ি একটি ঐতিহ্যপূর্ণ কালীমন্দির।
‘কালী’ শব্দটি ‘কাল’ শব্দের স্ত্রীলিঙ্গ। এই শব্দের অর্থ ‘কৃষ্ণ’ (কালো) বা ‘ঘোর বর্ণ’। হিন্দু মহাকাব্য মহাভারত-এ যে ভদ্রকালীর উল্লেখ আছে, তা দেবী দুর্গারই একটি রূপ। মহাভারত-এ ‘কালরাত্রি’ বা ‘কালী’ নামে আরও এক দেবীর উল্লেখ পাওয়া যায়। ইনি যুদ্ধে নিহত যোদ্ধৃবর্গ ও পশুদের আত্মা বহন করেন। আবার হরিবংশ গ্রন্থে কালী নামে এক দানবীর উল্লেখ পাওয়া যায়।
‘কাল’ শব্দের দুটি অর্থ রয়েছে: ‘নির্ধারিত সময়’ ও ‘মৃত্যু’। সমোচ্চারিত শব্দ ‘কালো’র সঙ্গে এর কোনো সম্পর্ক না থাকলেও, সংস্কৃত সাহিত্যের বিশিষ্ট গবেষক টমাস কবার্নের মতে, ‘কালী’ শব্দটি ‘কৃষ্ণবর্ণ’ বোঝানোর জন্যও ব্যবহৃত হতে পারে।
***জয় মা কালী।***
মহালয়া কি ? কেন এই মহালয়া ? মহালয়া কি গুরুত্ব ধারন বা পালন করে ?

সবাই নিশ্চিত মহালয়া মানে দূর্গাপূজার দিন গোনা , মহালয়ার ৬ দিন পর মহাসপ্তমি , তাই দেবিকে আমত্রন ইত্যাদি । মহালয়ার তার চেয়ে বড় গুরুত্ব আছে , সেটা কেউ কেউ জানেন , কেউ কেউ জানেন না ।
ত্রেতা যুগে ভগবান শ্রীরামচন্দ্র অকালে দেবিকে আরাধনা করেছিলেন লঙ্কা জয় করে সীতাকে উদ্ধারের জন্য আসল দূর্গা পূজা হলো বসন্তে , সেটাকে বাসন্তি পূজা বলা হয় । শ্রীরামচন্দ্র অকালে-অসময়ে পূজা করেছিলেন বলে এই শরতের পূজাকে দেবির অকাল-বোধন বলা হয় ।
সনাতন ধর্মে কোন শুভ কাজ করতে গেলে , বিবাহ করতে গেলে প্র্রয়াত পূর্বরা, যাদের পিতা-মাতা তাদের পিতা-মাতার জন্য , সাথে সমগ্র জীব-জগতের জন্য তর্পণ করতে হয়, কার্যাদি-অঞ্জলি প্রদান করতে হয় । তর্পণ মানে খুশি করা । ভগবান শ্রীরাম লঙ্কা বিজয়ের আগে এদিনে এমনই করেছিলেন ।
সেই অনুসারে এই মহালয়া তিথিতে যারা পিতৃ-মাতৃহীন তারা তাদের পূর্বপূরূষের স্মরন করে, পূর্বপূরুষের আত্নার শান্তি কামনা করে অঞ্জলি প্রদান করেন । সনাতন ধর্ম অনুসারে এই দিনে প্রয়াত আত্নাদের মত্যে পাঠিয়ে দেয়া হয়, প্রয়াত আত্নার যে সমাবেশ হয় তাহাকে মহালয় বলা হয় । মহালয় থেকে মহালয়া ।পিতৃপক্ষের ও শেষদিন এটি ।
সনাতন ধর্ম অনুসারে বছরে একবার পিতা-মাতার উদ্দেশ্যে পিন্ড দান করতে হয় , সেই তিথিতে করতে হয় যে তিথিতে উনারা প্রয়াত হয়েছেন । সনাতন ধর্মের কার্যাদি কোন তারিখ অনুসারে করা হয় না । তিথি অনুসারে হয় ।
মহালয়াতে যারা গঙ্গায় অঞ্জলি প্রদান করেন পূর্বদের আত্নার শান্তির জন্য , তাহারা শুধু পূর্বদের নয় , পৃথিবীর সমগ্র কিছুর জন্য প্রার্থনা ও অঞ্জলি প্রদান করেন ।
যে-অবান্ধবা বান্ধবা বা যেন্যজন্মনি বান্ধবা - অর্থাৎ যারা বন্ধু নন, অথবা আমার বন্ধু ও , যারা জন্ম জন্মাত্নরে আমার আত্নীয় বন্ধু ছিলেন , তারা সকলেই আজ আমার অঞ্জলি গ্রহন করুন
যাদের পুত্র নেই , যাদের কেউ নেই আজ স্মরন করার তাদের জন্য ও অঞ্জলী প্রদান করতে হয় ।
যেযাং, ন মাতা, ন পিতা, ন বন্ধু - অর্থাৎ যাদের মাতা-পিতা-বন্ধু কেউ নেই আজ স্মরন করার তাদেরকে ও স্মরন করছি ও প্রার্থনা করছি তাদের আত্না তৃপ্তিলাভ করুক ।
ত্রেতা যুগে ভগবান শ্রীরামচন্দ্র অকালে দেবিকে আরাধনা করেছিলেন লঙ্কা জয় করে সীতাকে উদ্ধারের জন্য আসল দূর্গা পূজা হলো বসন্তে , সেটাকে বাসন্তি পূজা বলা হয় । শ্রীরামচন্দ্র অকালে-অসময়ে পূজা করেছিলেন বলে এই শরতের পূজাকে দেবির অকাল-বোধন বলা হয় ।
সনাতন ধর্মে কোন শুভ কাজ করতে গেলে , বিবাহ করতে গেলে প্র্রয়াত পূর্বরা, যাদের পিতা-মাতা তাদের পিতা-মাতার জন্য , সাথে সমগ্র জীব-জগতের জন্য তর্পণ করতে হয়, কার্যাদি-অঞ্জলি প্রদান করতে হয় । তর্পণ মানে খুশি করা । ভগবান শ্রীরাম লঙ্কা বিজয়ের আগে এদিনে এমনই করেছিলেন ।
সেই অনুসারে এই মহালয়া তিথিতে যারা পিতৃ-মাতৃহীন তারা তাদের পূর্বপূরূষের স্মরন করে, পূর্বপূরুষের আত্নার শান্তি কামনা করে অঞ্জলি প্রদান করেন । সনাতন ধর্ম অনুসারে এই দিনে প্রয়াত আত্নাদের মত্যে পাঠিয়ে দেয়া হয়, প্রয়াত আত্নার যে সমাবেশ হয় তাহাকে মহালয় বলা হয় । মহালয় থেকে মহালয়া ।পিতৃপক্ষের ও শেষদিন এটি ।
সনাতন ধর্ম অনুসারে বছরে একবার পিতা-মাতার উদ্দেশ্যে পিন্ড দান করতে হয় , সেই তিথিতে করতে হয় যে তিথিতে উনারা প্রয়াত হয়েছেন । সনাতন ধর্মের কার্যাদি কোন তারিখ অনুসারে করা হয় না । তিথি অনুসারে হয় ।
মহালয়াতে যারা গঙ্গায় অঞ্জলি প্রদান করেন পূর্বদের আত্নার শান্তির জন্য , তাহারা শুধু পূর্বদের নয় , পৃথিবীর সমগ্র কিছুর জন্য প্রার্থনা ও অঞ্জলি প্রদান করেন ।
যে-অবান্ধবা বান্ধবা বা যেন্যজন্মনি বান্ধবা - অর্থাৎ যারা বন্ধু নন, অথবা আমার বন্ধু ও , যারা জন্ম জন্মাত্নরে আমার আত্নীয় বন্ধু ছিলেন , তারা সকলেই আজ আমার অঞ্জলি গ্রহন করুন
যাদের পুত্র নেই , যাদের কেউ নেই আজ স্মরন করার তাদের জন্য ও অঞ্জলী প্রদান করতে হয় ।
যেযাং, ন মাতা, ন পিতা, ন বন্ধু - অর্থাৎ যাদের মাতা-পিতা-বন্ধু কেউ নেই আজ স্মরন করার তাদেরকে ও স্মরন করছি ও প্রার্থনা করছি তাদের আত্না তৃপ্তিলাভ করুক ।
মহালয়া কি??

শারদীয়া দুর্গাপূজাকে "অকালবোধন" বলা হয়। কালিকা পুরাণ ও বৃহদ্ধর্ম পুরাণ অনুসারে, রাম ও রাবণের যুদ্ধের সময় শরৎকালে দুর্গাকে পূজা করা হয়েছিল। পুরাণ অনুসারে, শরৎকালে দেবতারা ঘুমিয়ে থাকেন। তাই এই সময়টি তাঁদের পূজা যথাযথ সময় নয়। অকালের পূজা বলে তাই এই পূজার নাম হয় "অকালবোধন"।এই দুই পুরাণ অনুসারে, রামকে সাহায্য করার জন্য ব্রহ্মা দুর্গার বোধন ও পূজা করেছিলেন। কৃত্তিবাস ওঝা তাঁর রামায়ণে লিখেছেন, রাম স্বয়ং দুর্গার বোধন ও পূজা করেছিলেন।এই জন্য স্মৃতিশাস্ত্রগুলিতে শরৎকালে দুর্গাপূজার বিধান দেওয়া হয়েছে।হংসনারায়ণ ভট্টাচার্যের মতে, "...অকালবোধন শরতে বৈদিক যজ্ঞের আধুনিক রূপায়ণ ছাড়া আর কিছুই না।"
সাধারণত আশ্বিন শুক্লপক্ষের ষষ্ঠ দিন অর্থাৎ ষষ্ঠী থেকে দশম দিন অর্থাৎ দশমী অবধি পাঁচ দিন দুর্গোৎসব অনুষ্ঠিত হয়। এই পাঁচটি দিন যথাক্রমে দুর্গাষষ্ঠী, মহাসপ্তমী, মহাষ্টমী, মহানবমী ও বিজয়া দশমী নামে পরিচিত। আবার সমগ্র পক্ষটি দেবীপক্ষ নামে আখ্যাত হয়। দেবীপক্ষের সূচনা হয় পূর্ববর্তী অমাবস্যার দিন; এই দিনটি মহালয়া নামে পরিচিত। অন্যদিকে দেবীপক্ষের সমাপ্তি পঞ্চদশ দিন অর্থাৎ পূর্ণিমায়; এই দিনটি কোজাগরী পূর্ণিমা নামে পরিচিত ও বাৎসরিক লক্ষ্মীপূজার দিন হিসাবে গণ্য হয়। দুর্গাপূজা মূলত পাঁচদিনের অনুষ্ঠান হলেও মহালয়া থেকেই প্রকৃত উৎসবের সূচনা ও কোজাগরী লক্ষ্মীপূজায় তার সমাপ্তি।
দূর্গাপূজা ২০১৫ এর সময়সূচীঃ
১৩ অক্টোবরঃ মহালয়া
১৮ অক্টোবরঃ মহাপঞ্চমী
১৯ অক্টোবরঃ মহাষষ্ঠী
২০ অক্টোবরঃ মহাসপ্তমী
২১ অক্টোবরঃ মহাঅষ্টমী
২২ অক্টোবরঃ মহানবমী ও বিজয়া দশমী।
১৩ অক্টোবরঃ মহালয়া
১৮ অক্টোবরঃ মহাপঞ্চমী
১৯ অক্টোবরঃ মহাষষ্ঠী
২০ অক্টোবরঃ মহাসপ্তমী
২১ অক্টোবরঃ মহাঅষ্টমী
২২ অক্টোবরঃ মহানবমী ও বিজয়া দশমী।
আদ্যা শক্তি তত্ত্ব
সৃষ্টিস্থিত্যন্ত -কারিণী জগদ্ধাত্রী যিনি - তিনিই করুণায়,স্নেহে,কৃপায় ভক্তের ভক্তির ডোরে ধরা দেন।
তন্ত্রগ্রন্থে এই আদ্যাশক্তির বিচিত্র লীলা-বিলাসের কথা প্রসঙ্গে বলা হয়েছে তাঁর দুটি রূপের কথা। একটিতে তিনি অসুরসংহারিণী, ভীমাভয়ঙ্করী, লোলজিহ্বা-রক্তনয়না, দিগম্বরী এলোকেশী, বহু অস্ত্র-শস্ত্রধারিণী রুদ্রণী। তাঁর ওই ভীষণামূর্তি সন্তানের ত্রাণের জন্যই। আর একটি বিগ্রহে তিনি সৌম্যাসৌম্যতরাশেষ সৌমেভ্যস্ত্বতিসুন্দরী’, করুণাময়ী, প্রসন্নবদনা, অনায়স্তাননা দেবী স্নিগ্ধ চন্দ্রাননা-অপূর্বরূপ-লাবণ্যময়ী জননীমূর্তি। এখানেও তিনি মুক্তিহেতু-ভূতা সনাতনী। সন্তানকল্যাণ-কামনায় সদাকৃপাসুমুখী । এই দুই রূপের নানা অভিব্যক্তিতে নানা নামে প্রাচীন যুগে ঋষিদের ধ্যানে তিনি ধরা দিয়েছেন। যিনি পার্বতী-সতী-উমা,দেবতাদের সম্মিলিত আহ্বানে তিনিই কখনও ভীষণা-দানবদলনী-চতুর্ভূজা-কালিকা,কখনও দশভুজা অষ্টাদশ-ভুজা-সহস্রভুজা দেবী মহিষমদির্নী, ভগবতী দুর্গা কৌষিকী। কখনও প্রসন্না মূর্তি সিংহাসন জগদ্ধাত্রী, কখনও বা অন্নদাত্রী অন্নপূর্ণা। কখনও ধনধান্যাধিষ্ঠাত্রী শ্রীময়ী মহালক্ষ্মী,কখনও সর্বশুক্লা-বিদ্যাবিজ্ঞানদাত্রী চতুঃষষ্ঠী-কলাময়ী দেবী বাগ্বাদিনী সরস্বতী। কখনও রোগমহামারী ত্রাণকর্ত্রী দেবী শীতলা, কখনবা পুত্রদা দেবী ষষ্ঠী। এসব তাঁরই লীলাবৈচিত্রে সাধকের ধ্যানে তার কল্যাণে মর্ত্যে সৃষ্ট বহুরূপ।
এছাড়াও বিচিত্ররূপিণী,নানা অঘটন ঘটন পটিয়সী দেবী মহামায়া স্বেচ্ছায় নিজ শরীর থেকে সৃষ্টি করেন আরও বহু লীলাবিগ্রহ। ‘জগৎউদ্ধার হেতবেও সন্তানদের’ মঙ্গলকামনায় একা তিনি বহু হন ;‘কখনও শ্বেত,কখনও পীত,কখনও নীল লোহিত রে।’ দেবী ভগবতীর বিশেষ পূজায় দেবীর এই সব সহচরীশক্তি মূর্তিদের আবহিন করে পূজা করতে হয়। এঁরা হচ্ছেন -কালী তাঁরা প্রভৃতি দশমহাবিদ্যা; জয়ন্তী মঙ্গলাদি একাদশ শক্তি; ব্রহ্মা-বিষ্ণু -মহেশ্বরাদির ক্রিয়াশক্তি -ব্রহ্মাণী,মাহেশ্বরী বৈষ্ণবী প্রভৃতি আষ্টশক্তি; উগ্রচণ্ডা প্রচণ্ডাদি দেবীর রণাঙ্গনে নিত্যসহচরী; শৈলপুত্রাদি নবদুর্গা; কালিকাদি চতুষষ্ঠী যোগিনী; কোটিযোগিনী ইত্যাদি।
এছাড়াও ভারতের নানা তীর্থে তীর্থ-স্বরূপিণী হয়ে বিরাজিতা একই আদ্যাশক্তি কখনও কামরূপিনী কামাখ্যা, কখনও চিরকুমারী তপস্বিনী দেরী কুমারী,কোথাও মীনাক্ষী,কখনও বা কামাক্ষী, কোথাও বিশালাক্ষী,কোথাও বা অন্নদাত্রী পরম-করুণাময়ী অন্নপূর্ণা ভবানী। এইসব একই দৈবশক্তির নানা নামে,নানা রূপে প্রকাশ। এছাড়াও প্রকৃতির বৃক্ষলতার মধ্যেও নানাভাবে তিনি বিরাজিতা। দুর্গাপূজায় আমরা যাকে কলাবৌ বলি সেই নবপত্রিকাবাসিনী নবদুর্গা নামেও তিনি পূজিতা হন ।
এই ভক্তাভীষ্টদায়িনী দেবী নিজেই বলেছেন -তেমরা যা চাইবে “মত্তঃ তৎ প্রাপ্যতাং সর্বং পরিতুষ্টা দদামিতৎ’’ । কিন্তু এই বহুরূপা-নানা ভাবধারিণী দেবী মূর্তিগুলি সবই তাঁর ঐশ্বর্য-বৈভব। লীলায় তিনি বহু হন। তত্ত্বতঃ তিনি অনন্যা,অদ্বিতীয়া,অপরিমেয়া । তিনি নিজেই সুনির্দিষ্টভাবে বলেছেন এক জিজ্ঞাসু মদগর্বী দানবসন্তানের প্রশ্নের উওরে, ‘একৈবাহং জগত্যত্র দ্বিতীয়া কা মমাপরা?’ আমি-আমিই মাত্র আাছি এ জগতের কর্ত্রী কারয়িত্রী-করণগুণময়ী কর্মহেতু স্বরূপা। আমিই এই জগতের আদি, ব্রহ্মাদি যত রূপ সবই আমার সৃষ্টি। মহাকাল আমারই নিয়ন্ত্রণে, আমি প্রলয়কালে সেই কালকেও গ্রাস করি তাই তো আমি মহাকালী। আর এই যে সব নানা বিচিত্র রূপে আমার সহচারিণী ও অন্যত্র প্রতিষ্ঠিতা শক্তি বিগ্রহ এইসব আমারই বিভূতি,‘মৎ বিভূতয’ ।
অভয়দায়িনী দেবী জগদম্বা-করুণার্দ্রাহ্দৃয়া দেবী তাঁর সন্তানদের প্রতি সদয়া হয়ে তাদের আশ্বস্ত করেন-“ ইত্থং যদা যদা বাধা দানবোত্থা ভবিষ্যতি। তদাতদাবতীর্য্যাহং করিষ্যামি অরিসংক্ষয়ং ’’। ‘যখন যখনই এই আসুরিক উত্পাতে আমার সন্তানেরা কাতর হয়ে আমার শরণ নেবে তখন তখনই আমি আবির্ভূত হয়ে তাদের রক্ষা করব’। আর ভরসার কথা,এই বর্তমান যুগের মানবদের কথাও স্মরণ করে তিনি বলেছেন -‘ত্রৈলোকস্য হিতার্থায়’-ত্রিলোক-স্বর্গ-মর্ত্য ও পাতালবাস দের আহ্বানেও তিনি আসবেন । ‘যশ্চ মর্ত্ত্যঃ স্তবৈরেভিস্তাং স্তোষ্যত্যমলাননে । তস্য বিত্তর্ধি বিভবৈর্ধনদারাদি-সম্পদাম। বৃদ্ধয়েহস্মৎ প্রসন্না ত্বং ভবেথাঃ সর্বদাম্বিকে।” আমাদের মতো অর্থাৎ দেবতাদের মতো মর্ত্যমানবের প্রতিওকৃপাসুমুখী হয়ে তুমি তাদের অভীষ্ট সব কিছু দান করে তার প্রতিও প্রসন্না থেকো। দেবতারা মায়ের কাছে মর্ত্যবাসীর জন্য এই আশীর্বাদও চেয়ে নিয়েছেন।
LIKE AND SHARE = শ্রী শ্রী মেহার কালীবাড়ি
শুভ মহালয়া
(০৯ অক্টোবর, ২০১৫ দৈনিক ইত্তেফাক)
সনাতন ধর্মের মাঙ্গলিক অনুষ্ঠানাদি কোনো তারিখ অনুসারে করা হয় না; হয় তিথি অনুসারে। আসছে শারদীয় দুর্গাপূজা- মহাশক্তির পূজা তিথি। উত্সবের আমেজ সবার মাঝে। শারদীয় দুর্গো্ৎসবের প্রধান তিনটি পর্ব হলো মহালয়া, বোধন আর সন্ধিপূজা। ১২ অক্টোবর, ২০১৫ শুভ মহালয়া। মাসে দুইটি পক্ষ; সৌর আশ্বিনের কৃষ্ণপক্ষের নাম ‘মহালয়া’। মহালয়ায় পিতৃপক্ষ শেষ করে দেবীপক্ষের দিকে যাত্রা হয় শুরু। সূর্য কন্যারাশিতে প্রবেশ করলে পিতৃপক্ষ সূচিত হয়। মহাভারত অনুযায়ী প্রচলিত কথায় আছে : প্রসিদ্ধ চরিত্র দাতা কর্ণের মৃত্যু হলে তাঁর আত্মা স্বর্গে গমন করে, সেখানে তাঁকে স্বর্ণ ও রত্ন খাদ্য হিসেবে প্রদান করা হয়। কর্ণ ইন্দ্রকে এর কারণ জিজ্ঞাসা করলে ইন্দ্র বলেন, কর্ণ সারা জীবন স্বর্ণই দান করেছেন, পিতৃগণের উদ্দেশ্যে কোনো দিন খাদ্য প্রদান করেননি। তাই, স্বর্গে তাঁকে স্বর্ণই খাদ্য হিসেবে প্রদান করা হয়েছে। কর্ণ বলেন, তিনি যেহেতু তাঁর পিতৃগণের সম্পর্কে অবহিত ছিলেন না, তাই তিনি ইচ্ছাকৃতভাবে পিতৃগণের জন্য কিছু পারেন নি। এই কারণে কর্ণকে ষোলো দিনের জন্য মর্ত্যে গিয়ে পিতৃলোকের উদ্দেশ্যে অন্ন ও জল প্রদান করার অনুমতি দেয়া হয়। এই পক্ষই পিতৃপক্ষ নামে পরিচিত হয়।সৌর উত্তরায়ণ দেবতাদের দিন, দক্ষিণায়ন হলো রাত। উত্তরায়ণের ৬ মাস দেবতারা জাগ্রত থাকেন, আর দক্ষিণায়নের ৬ মাস নিদ্রায় থাকেন। এদিন দক্ষিণায়নের প্রথম দিন ঘুম ভেঙে জেগে উঠেই বদ্ধ দুয়ার ঠেলে পিতৃপুরুষরা ছুটে আসবেন মর্ত্যলোকে। সনাতনধর্ম অনুসারে এই দিনে প্রয়াতগণের আত্মা মর্ত্যে পাঠিয়ে দেয়া হয়, প্রয়াত আত্মার যে সমাবেশ হয় তাকে ‘মহালয়’ বলা হয়। মহালয় থেকে মহালয়া। আরও একটু পরিষ্কার করে বলতে হয়—‘মহালয়’ বলতে বোঝায় মহান+ আলয়=মহালয়। তার সঙ্গে স্ত্রীকারান্ত ‘আ’। মহালয় হচ্ছে পূজা বা উত্সবের আলয় বা আশ্রয়। কিন্তু মহালয়া (স্ত্রীলিঙ্গ) হলো কেন? পিতৃপক্ষের অবসানে, অন্ধকার অমাবস্যার সীমানা ডিঙিয়ে আমরা যখন আলোকময় দেবীপক্ষের আগমনকে প্রত্যক্ষ করি তখনই সেই মহালগ্নটি আমাদের জীবনে ‘মহালয়ার’ বার্তা বহন করে আনে। এক্ষেত্রে স্বয়ং দেবীই হচ্ছে সেই মহান আশ্রয়, তাই উত্তরায়ণের লগ্নটির নাম ‘মহালয়া’। মানে মহান আলোয় দুর্গতিনাশিনী দেবী দুর্গাকে আবাহন।
মর্ত্যে এসে প্রয়াতের আত্মা ক্ষুধা-তৃষ্ণায় কাতর থাকেন। উত্তরপুরুষদের হাতে একটু শ্রাদ্ধাহার পেলেই তারা পরম তৃপ্ত হন। জলদানের মাধ্যমে পিতৃলোকের তৃপ্তিসাধনই হলো ‘তর্পণ’। তর্পণ কেন করা হয়? ‘তর্পণ’ মানে খুশি করা। সনাতন ধর্মে কোনো শুভ কাজ করতে গেলে, বিবাহ করতে গেলে প্রয়াত পূর্বপুরুষগণের আশীর্বাদ প্রার্থনা করে, তাঁদেরকে খুশি করে শুভ কাজটি করতে ব্রতী হয়। যাদের পিতা-মাতা প্রয়াত তাদের পিতা-মাতার জন্য, সাথে সমগ্র জীব-জগতের জন্য ‘তর্পণ’/ কার্যাদি-অঞ্জলি প্রদান করতে হয়। তাঁদের সঙ্গেই পিতৃতর্পণের মাধ্যমে আমরা মানসিক ও আত্মিক সংযোগ স্থাপন করি, তাঁদেরই প্রতি আমাদের শ্রদ্ধা ও প্রণাম নিবেদন করি। আশ্বিন মাসের এই কৃষ্ণপক্ষের অবসান ও দেবীপক্ষের সূচনায় যে অমাবস্যাকে আমরা ‘মহালয়া’ হিসেবে চিহ্নিত করি, সেই দিনটি হচ্ছে পিতৃপূজা ও মাতৃপূজার সন্ধিলগ্ন। পিতৃপূজা ও মাতৃপূজার মাধ্যমে এই দিনটিতে আমরা আমাদের এই মানব জীবনকে মহান করে তুলতে প্রয়াসী হই। শুধু তাই নয়, মহালয়ায় প্রার্থনা করি- যারা বন্ধু নন, অথবা আমার বন্ধুও, যারা জন্ম জন্মান্তরে আমার আত্মীয়-বন্ধু ছিলেন, তারা সকলেই আজ আমার অঞ্জলি গ্রহণ করুন। আজ মহালয়ায় স্মরণ করার জন্য-যাদের মাতা-পিতা-বন্ধু কেউ নেই, তাদেরকেও স্মরণ ও মঙ্গলের প্রার্থনা করতে হয়- তাদের আত্মা তৃপ্তিলাভ করুক। মার্কণ্ডেয় পুরাণে বলা হয়েছে, পিতৃগণ তর্পণে/ শ্রাদ্ধে তুষ্ট হলে স্বাস্থ্য, ধন, জ্ঞান ও দীর্ঘায়ু এবং পরিশেষে উত্তরপুরুষকে স্বর্গ ও মোক্ষ প্রদান করেন।
মহালয়ার দিন কৈলাশ থেকে মা দুর্গা পিতৃগৃহে আগমন করেন। দেশের বিভিন্ন মন্দিরে দেবী দুর্গার আগমনী বার্তায় হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের ঘরে ঘরে উত্সবের আনন্দ শুরু হয়। দুর্গাপূজার বাজনা বেজে উঠে সারা দেশে। দশপ্রহরণধারিণী মহাশক্তিরূপী মা দুর্গা প্রতিটি মণ্ডপে অবস্থান করবেন। সে লক্ষ্যে প্রতিটি মণ্ডপে ১২ অক্টোবর সোমবার ভোর থেকে (প্রত্যুষে) মন্দিরের চারপাশে পুরোহিতের ভক্তিকণ্ঠে শ্রীশ্রীচণ্ডীর মন্ত্র। ‘যা দেবী সর্বভূতেষু মাতৃরূপেণ সংস্থিতা।/ নমস্তৈস্য নমস্তৈস্য নমস্তৈস্য নমো নমঃ’ কিংবা ‘চণ্ডিকে সততং যুদ্ধে জয়ন্তি পাপনাশিনী।/ রূপং দেহি জয়ং দেহি যশো দেহি দ্বিষো জহি মন্ত্র উচ্চারণের ভেতর দিয়ে দূর কৈলাশ ছেড়ে মা দুর্গা পিতৃগৃহে আসবেন। দেবী দুর্গার আগমনে বিভিন্ন মণ্ডপে ধূপের ধোঁয়ায় ঢাক-ঢোলক, কাঁসর বাজবে, মঙ্গলপ্রদীপ প্রজ্বলনে মুহুর্মুহু উলুধ্বনি হবে। মহালয়া মানে দুর্গাপূজার দিন গণনা, মহালয়া সূচনার ষষ্ঠ দিন অর্থাত্ আগামী ১৯ অক্টোবর থেকে ষষ্ঠীপূজার মাধ্যমে আনুষ্ঠানিক সূচনা ঘটবে ৫ দিনব্যাপী শারদীয় দুর্গোত্সবের। তবে মূলত সেইদিন থেকেই শুরু হবে দেবী দুর্গার আগমন ধ্বনি। এ বছরের ‘সুদর্শন’ পঞ্জিকা মতে, এবার দেবীর আগমন ঘটবে ঘোটকে। এর ফল হচ্ছে ছত্রভঙ্গ। আর প্রস্থান করবেন দোলায়, ফল- মড়ক।
শুভ মহালয়া অনুষ্ঠানটি প্রতি বছর মানব জাতিকে মনে করে দেয়- দেবীর আবির্ভাব ও আগমন। সাথে এই বার্তাও নিয়ে আসে যে, যেখানেই অশুভ শক্তির বিস্তার, সেখানেই হবে শুভ শক্তির উত্থান। সকল শুভ শক্তির জয় কামনায়- শুভ মহালয়ার পুণ্যক্ষণে পিতৃমাতৃ আত্মার প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদনের মাধ্যমে শেষ করছি- ওঁ পিতা স্বর্গঃ পিতা ধর্ম পিতাহি পরমন্তপঃ।/ পিতরি প্রীতিমাপন্নে প্রীয়ন্তে সর্বদেবতাঃ / যত্প্রসাদং জগত্দৃষ্টং পূর্ণকামো যদাশিষা/ প্রত্যক্ষ দেবতায়ৈ মে তুব্যং মাতৃ নমো নমঃ
লিখেছেন- গৌরমোহন দাস
[লেখক :অনুসন্ধানী প্রাবন্ধিক, দফতর সম্পাদক-বাংলাদেশ জাতীয় হিন্দু সমাজ সংস্কার সমিতি, কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী পরিষদ এবং সহযোগী সম্পাদক- সুদর্শন পঞ্জিকা]
মহাকালকে যিনি গ্রাস করেন তিনিই হচ্ছেন কালী
"কলনাৎ সর্ব ভূতানাং সঃ কালঃ পরিকীর্ত্তিতঃ
মহাকালস্য কলনাৎ সঃ কানী পরিকীর্তিতা।"
তাৎপর্যঃ- সর্বভূত অর্থাৎ জীবজগতকে যিনি কলন অর্থাৎ গ্রাস করেন, তিনি কাল বা মহাকাল। আর মহাকালকে যিনি গ্রাস করেন তিনিই হচ্ছেন কালী। আমরা কালি বলতে দক্ষিনা কালীকেই বুঝি। কালীঘাট থেকে আরম্ভ করে বাংলার সর্বত্রই দক্ষিণাকালী বিরাজমান। দক্ষিন শব্দের অর্থ পুরুষকে বোঝায়। বামা বোঝায় শক্তিকে। শক্তি যখন পুরুষকে দ্রবীভূত করে তখন শক্তির অনুবর্তী হয় পুরুষ। তখন শক্তি মহামোক্ষদায়িনীরূপে আমাদের নিকট প্রতিভাত হন। এ জন্য আমরা কালী বলতে দক্ষিণাকালীকেই বুঝে থাকি।
বৃহদারণ্যক উপনিষদে আমাদের অসৎ হতে সৎ -এ নিয়ে যাওয়ার জন্য, অন্ধকার থেকে আলোতে এবং মৃত্যু থেকে অমৃতত্বে যাওয়ার জন্য প্রার্থনা করা হয়েছে। পরলোকগত স্বজন ও বন্ধুগণ যাতে ঐ সব ভয়ঙ্কর অন্ধকার অতিক্রম করে গন্তব্য স্থল অমৃতধামে যেতে পারেন তার জন্য ঐ দিন রাতে নদীর জলে জলন্ত প্রদীপ ভাসানোর প্রথা বাংলার কোন কোন জায়গায় দৃষ্ট হয়। আবার আশ্বিনের সংক্রান্তি থেকে কার্তিক মাসব্যাপী আকাশ প্রদীপ জ্বালানোর মাধ্যমে অশুভ শক্তি তাড়ানোর ব্যবস্থা এতে নিহিত রয়েছে।
কালী বিলাসতন্ত্রে বলা হয়েছে -
"কার্ত্তিকে কৃষ্ণ পক্ষে তু পক্ষদশ্যাং মহানিশি।
আবির্ভূতা মহাকালী যোগিনী কোটিভিঃ সহ।।"
অর্থাৎ -- কার্ত্তিক মাসের অমাবস্যার মহানিশিতে মহাদেবীর এই ভূ-মন্ডলে আবির্ভাব তিথি। এদিন দীপাবলী বা দীপদান তথা দেওয়ালী রজনী। কার্ত্তিক অমাবস্যার রাতে দীপদানে আলোক মালায় প্রজ্জ্বলিত করে নিজেদের অন্ধকার থেকে আলোকে নিয়ে যাওয়ারই নামান্তর দীপাবলী। আলোর মাধ্যমে শক্তি সাধনায় নিজেকে পুণ্যালোকে আলোকময় করে তোলাই জগতের মূলে শক্তি সাধনার অন্তনির্হিত তাৎপর্য্যের সার্থকতা।রহস্যপূজা এবং সাধন রহস্যে বলা হয়েছে ----
"ন দিবা পূজায়দ্দেবীং রাত্রৌ নৈব চ নৈবচ।
সর্বদা পূজয়ে দেবীং দিবা রাত্রৌ বিবর্জয়েৎ।।"
অর্থাৎ -দেবীকে দিনে ও না, রাত্রিতে ও না সর্বদাই পূজা করবে।
কালীর দ্বিবিধরূপ - সংহাররূপ ও সৃষ্টিরূপ।
সংহাররূপ - কালী সংহারমূর্ত্তি। কিন্তু এই সংহার নিষ্ঠুর ধ্বংস নয়। এই সংহার সংহরণ অর্থাৎ আপনার মধ্যে আকর্ষণ। সমুদ্রের তরঙ্গমালার উদ্ভব সমুদ্র থেকেই। আবার সেই তরঙ্গমালার লয়ও হয় সমুদ্র বক্ষে। সংহার তেমনই একটি ব্যাপার। এটি হলো তার নাশিনী শক্তি।
সৃষ্টিরূপ - আদ্যাশক্তি বিশ্বপ্রসবকারিনী মায়ের উদর থেকেই জগৎ প্রপঞ্চের সৃষ্টি। তখন তিনি সৃজনী শক্তি।
জীবনের সাথে এই শক্তির খেলা আর্য্য প্রচীন সাধকগণ তাঁদের জ্ঞানদীপ্ত উপলব্ধিতে প্রত্যক্ষ করেছেন। এই সৃষ্টিতে প্রকৃতিরূপা মাতৃশক্তির রূপ কল্পনা কালী মূর্তিতে। শক্তির আধারভূতা দেবী শ্রী শ্রী কালীমাতা সকলের পরিত্রাণ করুন, সকলের জীবনে কালীমায়ের মূর্তির তাৎপর্য প্রাণবন্ত হোক, কর্মে সাত্ত্বিকতা আসুক- এই প্রার্থনা রাখি।
আধ্যাত্মিক বৈদিক, লৌকিক, আঞ্চলিক দেবদেবীর বাহনরূপে পশুপাখির অবস্থান নির্দিষ্ট হয়েছে। কিন্তু ব্যতিক্রম হলো দেবী কালিকার ক্ষেত্রে। এখানে দেবীর বাহনরূপে শিব ও শবকে বাহন নির্দিষ্ট হয়েছেন। দেবীকে শিবারূঢ়া বলতে শিবের উপর অবস্থিত বোঝায়, অপর পক্ষে শিবা শব্দে শৃগালও বোঝায়। এ কারণে অনেক স্থলে মায়ের মূর্তির সাথে শৃগালকেও দেখানো হয়। কিন্তু মায়ের সাথে শৃগালের যুক্ততা যুক্তিগ্রাহ্য নয়। শবারূঢ়া বা শিবারূঢ়া যা-ই বলি শব হয় শক্তিহীনতায় আর শিব হয় মঙ্গলকারী শক্তিমানতায়। উভয়ই শক্তির অবস্থান নির্ণয় করে। যে শক্তি সর্বত্র বিরাজিত নানরূপে কার্যকারিতায় তাঁর বাহন নির্ধারণ না করাই যুক্তিগ্রাহ্য বলে সাধকগণ এ বিষয়ে দৃষ্টি দেননি। ঋষি অরবিন্দ বিশ্বাস করতেন শাস্ত্রে মায়ের যে সকল মূর্তি আছে তাঁর মধ্যে মূলে রয়েছে কালীমাতা। শ্রী অরবিন্দেরও কালী দর্শন হয়েছিল যা অনেকেরই অজানা। মা সৃষ্টি ও রক্ষা দু’টোই করেন। ধ্বংস অনিবার্যভাবে সৃষ্টির ক্রম অনুযায়ী আসে। মানুষ বিপদে পড়লে মাকে ডাকে। ছোট শিশু মায়ের স্পর্শেই শক্তি পায়। পরিশ্রান্ত, ক্লান্ত মানুষ ঘুমের মাধ্যমে মায়ের কোলে আশ্রয় নিয়ে পুনঃশক্তি সঞ্চার করে কর্মে প্রবৃত্ত হয়। মায়ের কোলেই সন্তানের যে কোন সময় একমাত্র নিরাপদ আশ্রয়। মায়ের সস্নেহেই মানুষের বৃদ্ধি ঘটে।
কালীবীজ জপলে ও তদনুযায়ী গুরুপাদিষ্ট মতে ক্রিয়া করলে তত্ত্বময়ী কালী সাধকের সঙ্গী হয়ে যান। কৃষ্ণানন্দ, রামপ্রসাদ, রামকৃষ্ণ, বামাক্ষেপা প্রমুখ সাধক কালী দর্শনে মুগ্ধ তন্ময়। ‘‘প্রত্যয় হয় প্রত্যক্ষ হলে।’’ সমস্ত যোগতত্ত্ব কথা গুরুবক্তগম্য। সকল তত্ত্ব নিজের কাছে বিশ্বাসযোগ্য মনে হবে যদি গুরুপাদিষ্ট মতে সাধন ভজন করা যায়। মানুষকে সাধনমুখী, সত্যমুখী করার জন্যই পূজার ও দেব-দেবীর মূর্তির অবতারণা।
কালীপূজা আমাদেরকে কালীতত্ত্বভিমুখী করুক-এই প্রার্থনা মায়ের শ্রী চরণে। কালী ভাবনায় জীবনের সকল কালো দূর হয়ে যাক আসুক মহাকালের গতি।
মা সর্বব্যাপী। তাই মাকে সর্বদা স্মরণে রেখে প্রণাম জানাই ----
'যা দেবী সর্বভূতেষু মাতৃরূপেন সংস্থিতা
নমস্তস্যৈ নমস্তস্যৈ নমস্তস্যৈ নমো নমঃ।'----- শ্রী শ্রী চন্ডী
Subscribe to:
Posts (Atom)